রামপুরায় ছয়তলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় করিম দম্পতির বসবাস। একজন মোশাররফ করিম, অন্যজন জুঁই করিম। সুনসান একটুকরো বেলকনি সেই ফ্ল্যাটের সামনের দিকটায়। আশপাশে সদর্পে আরো অনেক অট্টালিকা আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত। তবু কোন রহস্যময়তায় সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই বেলকনিতে হামাগুঁড়ি দেয় সকালের নরম স্বচ্ছ রোদ। ঘোষণা দিয়ে যায় ফুরফুরে পবিত্র একটি দিনের। কিন্তু সে বারতা কি মোশাররফ করিমের কান পর্যন্ত পৌঁছায়? সম্ভব কি হয় সকালের সে রোদ গায়ে মাখার? মনে হয় না। গত রাতেও তিনি বাসায় ফিরেছেন প্রায় ভোর রাতে। শুটিং শেষ করেছেন রাত আড়াইটায়; বাসায় ফিরতে ফিরতে ভোর ৫টা। একটু ঘুমিয়েই সকাল ১০টায় উঠতে হয়েছে অন্য একটি সিরিয়ালের শুটিংয়ে যাওয়ার জন্য। চোখ দুটো তাই পাকা মরিচের মতো টকটকে লাল। বোঝাই যাচ্ছে, আরো অনেকক্ষণ ঘুমাতে চান তিনি। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাশে পাশে একজন সর্বক্ষণ-জুঁই; অর্ধাঙ্গিনী অথবা পূর্ণাঙ্গিনী-বলা চলে দুটোই। শুটিংয়ে যাওয়ার জন্য বহু কষ্টে মোশাররফকে টেনে তুলেছেন ঘুম থেকে।
এ তো গেল এক দিনকার চিত্র_৩০ দিনের এক দিন অথবা ৩৬৫ দিনের এক দিন। এমনইভাবে মাস অথবা বছরের সব দিনেই সরব জুঁই। সংসারের খুঁটিনাটি, আত্মীয়স্বজন, পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মোশাররফ করিমের অভিনয়ের সমালোচনা_সব ক্ষেত্রেই দুরন্ত বিচরণ তাঁর। শেষ কথাটি কি একটু খটমট ঠেকল? হ্যাঁ, মোশাররফ করিমের অভিনয়ের খুঁত বের করার স্বঘোষিত মহান দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছেন জুঁই। 'মনে হয়, আমিই মোশাররফের সবচেয়ে বড় সমালোচক। যদিও ওর অভিনয়ে খুঁত থাকে না বললেই চলে; তবু কিছু কিছু বিষয় খোঁজার চেষ্টা করি, যেটা হলে হয়তো ওই চরিত্রটা আরো ভালো করা যেত।' বলতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত জুঁই। জুঁইয়ের নিপুণতার আরেকটি প্রমাণ মিলল তাঁদের বাসার ছোট্ট ড্রইংরুমের এক পাশে থরে থরে সাজানো বইয়ের তাক দেখে। সমৃদ্ধ কালেকশন। ক্যামেরা-কৌশল থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজের কবিতা_সবই উপস্থিত। দুজনই বইপ্রিয়। মোশাররফ তো শুটিংয়ের বিরতিতেও বই নিয়ে বসে যান মাঝেমধ্যে।
'খ্যাতির বিড়ম্বনা' মোশাররফ করিমকেও শাসিয়ে যায় প্রায়ই। ভক্তদের সতর্ক চোখ তো আছেই, সম্প্রতি একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। ১২ ডিসেম্বর রাতে মোশাররফের মৃত্যুর গুজব রটে। শুরু হয় ফোন কল! মোশাররফ ওই সময় প্রতিটি কল রিসিভ করে কথা বলেছেন। হাসিমুখে জানিয়ে দিয়েছেন, 'চিন্তার কোনো কারণ নেই, বেঁচে আছি আমি।' তাঁর প্রতি ভক্তদের যে অদ্ভুত ভালোবাসা, তাঁর উষ্ণ প্রকাশ সেদিন মোশাররফকে ছুঁয়ে গেছে প্রবলভাবেই। পরিবারে একদমই সময় দিতে পারেন না মোশাররফ করিম। অবসর বলতে দুই ঈদ। এ সময়টায় আত্মীয়স্বজনের বাসায় ঘুরে ঘুরে নিজেদের মতো করে কাটানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। সারা বছরই এক ধরনের অপ্রত্যাশিত দূরত্ব থাকে দুজনের মধ্যে। তবে এ দূরত্ব ঘোচানোর জন্য খুবই আন্তরিক মোশাররফ। কোনো কারণে শুটিং বাতিল হলে সোজা বাসায় চলে আসেন অথবা জুঁইকে ডাকেন বন্ধুদের আড্ডায়। মাঝেমধ্যে সেটে উপস্থিত থাকেন জুঁই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন জুঁই। ক্যামেরার পেছনে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন, বৃত্তের বাইরে নেই অভিনয়টাও। ক্যামেরার সামনে তিনি এখন আর দশজন অভিনয়শিল্পীর মতোই স্বাভাবিক। দিন-রাত পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে অভিনীত নাটকের সংখ্যা। মজার বিষয়, বেশির ভাগ নাটকেই মোশাররফ-জুঁই অভিনয় করেছেন দম্পতির ভূমিকায়। তালিকায় রয়েছে 'মুখ ও মুখোশ', 'অপহরণের পর', ধারাবাহিক 'দুই টাকার বাহাদুরি'সহ বেশ কিছু নাটক। আর এখন করছেন ধারাবাহিক 'বিশেষ দ্রষ্টব্য'-এর শুটিং।
দুজনের এই একসঙ্গে একপথে চলার রহস্যটা কী? জুঁই জানালেন, 'মোশাররফ যে সেটে কাজ করে, সেখানকার পরিবেশটা আমার কাছে পরিবারের মতোই। আনন্দ করে কেটে যায় পুরো সময়টা। মনেই হয় না কাজ করছি। ইউনিটের সবাই পরিচিত থাকে, যে কারণে আমার প্রতি আন্তরিক থাকে সবাই। এ ছাড়া আরো একটা কারণ আছে, সারা বছর ওকে কাছে পাই খুব কম। এক সেটে কাজ করার ফলে পাশাপাশি থাকতে পারি। অভিনয়টা যেহেতু ওকে দেখেই শিখেছি, তাই একসঙ্গে থাকলে মনে সাহস পাই।' এ সাহসকে পুঁজি করেই জুঁই কাজ করে চলেছেন। করতে চান আরো। মাসের পনেরোটা দিন ব্যস্ত থাকতে চান অভিনয় নিয়েই। কিন্তু যাঁর কাঁধে ভর করে তাঁর এই পথচলা, অভিনয় শেখা, সেই মোশাররফের মতামত কী জুঁইয়ের অভিনয় সম্পর্কে? 'আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা নাটকে কাজ করেছি। আমার চোখে ওর খুঁত বেশি ধরা পড়ে। তবে ওর মেধা আছে, চেষ্টা করলে আরো ভালো করবে। ওর ভালো একটা গুণ হচ্ছে, কোনো বিষয় ধরিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায়। অভিনয়টা যেহেতু মনস্তাত্তি্বক জগতের একটা বিষয়, সেহেতু ভালো করার কোনো শেষ নেই।' মোশাররফ করিমের এ রকম কমপ্লিমেন্ট বোধ হয় জুঁইকে প্রেরণা দিচ্ছে আরো বেশি। জুঁই চান মোশাররফের সঙ্গে এভাবেই আরো অনেকটা পথ চলতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন